গবেষণার ফলাফলঃ বাংলাদেশে গুড ফার্মেসি প্র্যাকটিসের প্রচলন

বিশ্বের যেকোন স্বাস্থ্যসেবায় ঔষধের ব্যবহার ভিষন গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রায়শই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর ভূমিকা অবমূল্যায়িত। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে, চিকিৎসা, এবং সুস্থ্য থাকার মত প্রাত্যহিকতায়ও সঠিক এবং কার্যকর ঔষধের ব্যবহার অনস্বিকার্য। প্রচলিত ধারনায় ঔষধের মান শুধুমাত্র ঔষধ তৈরির কাচাঁমাল বা প্রস্তুতকারকের মানের উপর নির্ভরশীল অথচ ঔষধের কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে সাপ্লাইচেইনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সাপ্লাইচেইনের শেষ ধাপটি রোগী হলেও, একমাত্র রোগীর হাতে ঔষধ পৌঁছানটা এখানে শেষ কথা নয় বরং রোগী সঠিক সময়ে, সঠিক ডোজে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক ঔষধ গ্রহন করছেন কিনা তার উপর নির্ভর করে। একটি ভালোমানের ঔষধ সঠিকভাবে সংরক্ষিত না হলে তার মান নষ্ট হতে থাকে এবং কার্যকরিতা হারায়। ফার্মেসিতে যেমন ঔষধ সঠিক মাননিয়ন্ত্রণ করে সংরক্ষন করতে হয় তেমনি রোগীকেও ব্যবহার্য ঔষধ সংরক্ষণ করতে হয় সঠিক ব্যবহারবিধি মেনে।

বাংলাদেশের ঔষধশিল্প সুপ্রতিষ্ঠিত এবং দেশ বিদেশের মাটিতেও বহুল সমাদৃত। কিন্তু বাংলাদেশের খুচরা/পাইকারী ঔষধ ব্যবস্থাপনার মান কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রথম খুচরা ঔষধের দোকানগুলোর সংখ্যা (প্রায় লক্ষ্য) এবং জনস্বাস্থ্যের উপর ঔষধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তাদের মানোন্নয়নে কাজ শুরু করে। বৃটিশ সরকারের অনুদানে বাংলাদেশে খুচরা ঔষধের দোকান ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ শুরু করে আর্ন্তজাতিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানম্যানেজমেন্ট সাইয়েন্সস ফর হেল্থএর বেটার হেলথ ইন বাংলাদেশ প্রকল্প। সরকারের উদ্দ্যোগে সাড়া দিয়ে খুচরা/পাইকারী ঔষধের দোকানগুলো কেমন হওয়া দরকার এবং কী করলে এসব দোকানে ঔষধ সঠিক মান সম্পন্ন থাকবে তার একটি মানদন্ড তৈরী করা হয়। তারা খুচরা ঔষধের দোকানগুলোকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে যার একটি মডেল ফার্মেসি এবং অপরটি মডেল মেডিসিন শপ নামে নামকরণ করা হয়।

মডেল ফার্মেসি হওয়ার অন্যতম শর্ত হল মডেল ফার্মেসিতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকবেন যার দায়িত্বে থাকবে পুরো ফার্মেসিটি। ফার্মেসির আয়তন হবে নূন্যতম ৩০০ বর্গফুট এবং থাকবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।ঔষধ বিক্রয়ের সাথে রোগীকে ঔষধ সেবনের পদ্ধতি বলে দেওয়া এবং নিয়মিত সঠিকভাবে ঔষধ গ্রহণ করার জন্য কাউন্সিলিং করা হবে ফার্মাসিস্টএর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

মডেল মেডিসিন শপ মূলত বাংলাদেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের সবত্র সঠিক ঔষধ সেবা নিশ্চিত করার জন্যে মডেল ফার্মেসি থেকে কিছুটা শিথিল শর্ত নিয়ে তৈরি। মডেল মেডিসিন শপের আয়তন নির্ধারণ করা হয়েছে নূন্যতম ১২০ বর্গফুট। গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট এর অপ্রতুল্যতার কারনে গ্রেড বি (ডিপ্লোমা) ফার্মাসিস্ট বা গ্রেডসি ফার্মেসি টেকনিশিয়ান থাকতে হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনের জন্যে তাদের কিছু প্রস্তুতি রাখতে হবে যেমন, ফ্যান এবং একজস্ট ফ্যান। ঔষধ বিক্রয়ের সাথে রোগীকে ঔষধ সেবনের পদ্ধতি বলে দেওয়া এবং নিয়মিত সঠিকভাবে ঔষধ গ্রহণ করার জন্য কাউন্সিলিং করা মডেল মেডিসিন শপের ফার্মাসিস্টেরও অন্যতম দ্বায়িত্ব।

সম্প্রতি বেটার হেলথ ইন বাংলাদেশ প্রকল্প মডেল মেডিসিন শপে কর্মরত ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের উপর একটি জরিপ করেছে। যে সকল ফার্মেসি টেকনিশিয়ান প্রকল্পের মাধ্যমে মডেল মেডিসিন শপের মানদন্ডের উপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে তাদের গুড ফার্মেসি প্র্যাকটিস বিষয়ক জ্ঞান যাচাই করাটাই ছিল জরিপের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের ৫টি জেলার ৫টি এলাকা (ঢাকা, চাঁদপুর, সিলেট, নাটোর এবং সাতক্ষীরা) থেকে মোট ২৫২ ফার্মেসিতে ২০২২ সালে জরিপটি করা হয়।

গবেষনার উল্লেখযোগ্য কিছু ফলাফল নিচে দেওয়া হলঃ

লাইসেন্স এবং নথিপত্রঃ সমস্ত খুচরা ঔষধের দোকানে ড্রাগ লাইসন্সে পাওয়া গেলেও জরিপের দিনে ১৫% লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ৩৪.% ফার্মেসি টেকনিশিয়ান তাদের ফার্মেসি রেজিস্ট্রেসন দেখাতে পেরেছে, যা ঔষধের দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য বাধ্যতামূলক।

প্রেস্ক্রিপসন এবং অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়ঃ জরিপকৃত সমস্ত মেডিসিন শপ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করে তারমধ্যে এক তৃতীয়াংশ বলেছেন তারা প্রেস্ক্রিপসন ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করেন না। অধকিাংশ ফার্মেসি টেকনিসিয়ান (৫৪.%)রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকের র্কোস র্পূণ করার জন্য পরামর্শ দেন এবং ৯৪% ফার্মেসি টেকনিশিয়ান অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ বিক্রয়ের জন্য একটি রেজিস্ট্রার খাতা রাখেন।

ঔষধ সংরক্ষণঃ যে সকল ঔষধের দোকান তাপমাত্রা সংবেদনশীল ঔষধ বিক্রয় করে তার প্রতিটি রেফ্রিজেটরে তাপমাত্রা সংবেদনশীল ঔষধ সংরক্ষণ করেন। কিন্তু রেফ্রিজেটরের তাপমাত্রা পরিমাপক থার্মোমিটার পাওয়া গেছে ৮৬% দোকানে। এই ৮৬% এর মধ্যে ৯৮% দোকান সঠিক তাপমাত্রায় ( ডিগ্রি) তাপমাত্রা সংবেদনশীল ঔষধ সংরক্ষণ করে। ৯৭.% ঔষধ দোকানরে মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ সংরক্ষনের জন্য একটি মুখবন্ধ কন্টেনার ব্যবহার করছে এবং ৮৯.% দোকান মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধের নাম একটি আলাদা রেজিস্ট্রার খাতায় লিপিবদ্ধ করছে।

জরিপটির শেষ প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশে গুড ফার্মেসি প্র্যাকটিসপ্রচলন করার জন্য কোনও পরার্মশ আছে কি না। ৪৯.% উত্তরে বলেন, নিয়মিত প্রশক্ষিণ, অনিবন্ধিত ঔষধের দোকান বন্ধ করা (২৫.%), মনিটরিং জোরদারকরণ (২৪.%), জনসচেতনবৃদ্ধির জন্য প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান করা (১৯.%), সকল ঔষধ এম. আর.পি তে বিক্রয় করা (১৩.%), ভালো প্র্যাকটিস করার জন্য পুরস্কার এবং অনিয়মের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা (.%), মেয়াদহীণ ঔষধ সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা (.%) এবং রেজিস্ট্রেসন সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজিকরণ (.%) ইত্যাদি জানায়।

গবেষনার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলা যায় প্রশিক্ষণ এবং দিকনির্দেশণাপ্রাপ্ত খুচরা ঔষধের দোকানগুলো গুড ফার্মেসি প্র্যাকটিস শুরু করেছে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের অধিকাংশ ঔষধের দোকানের চিত্র নয় যদিও নিয়মিত প্রশিক্ষণ,মনিটরিং, আইনপ্রয়োগ এবং প্রনোদনার মাধ্যমে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।